রাজধানীর চার নারী এসি ল্যান্ড

বিশেষ প্রতিনিধি : এই মুহূর্তে ঢাকায় কর্মরত ১১ জন সহকারী কমিশনার (ভূমি) বা এসি ল্যান্ডের মধ্যে ৪ জনই নারী। এমন নয় যে ভূমি অফিস পরিচালনায় নারীরা এই প্রথম, তবে রাজধানী শহরে একই সঙ্গে চারজন নারী কাজ করেছেন, এটি উল্লেখযোগ্যই। এই চার নারী এসি ল্যান্ড হলেন—লালবাগ রাজস্ব সার্কেলের ফারজানা রহমান, কোতোয়ালি রাজস্ব সার্কেলের শাকিলা বিনতে মতিন, মোহাম্মদপুর রাজস্ব সার্কেলের ইয়াসমিন মনিরা এবং মতিঝিল রাজস্ব সার্কেলের মাহনাজ হোসেন ফারিবা।

সরকারের প্রশাসনব্যবস্থার প্রায় প্রবেশিকা অথচ গুরুত্বপূর্ণ পদ এসি ল্যান্ড। এই পদের কর্মকর্তারা সরকারের হয়ে মাঠপর্যায়ে জমির খাজনা আদায়, রক্ষণাবেক্ষণ, মালিকানার অধিকার দেওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো করে থাকেন। তাঁদের দায়িত্ব নিয়ে চালাতে হয় নিজ সার্কেলের ভূমি অফিসও।

বাংলাদেশের ভূমি ব্যবস্থাপনায় নারীদের অংশীদারত্ব উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কম। আইনে উত্তরাধিকার বা বৈবাহিক সূত্রে নারীদের ভূমির অধিকার পাওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে তার প্রয়োগ কম। ২০১৫ সালে অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাতের করা এক গবেষণায় পাওয়া যায়, বাংলাদেশের মাত্র ৪ শতাংশ জমির মালিক নারী। ২০১৯ সালে আন্তর্জাতিক সংস্থা অক্সফামের করা আরেক গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে পুরুষের ভূমির মালিকানা নারীর চেয়ে ৬ গুণ বেশি। সেখানে ঢাকার মতো জনবহুল শহরে ভূমি ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন নারীদের জন্য কঠিন কাজই বটে। ভূমিসংক্রান্ত কাজের পাশাপাশি নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা, করোনাকালীন ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের সহায়তা বিতরণের মতো কাজও করতে হয় তাঁদের।

চারজনের পটভূমি চার রকম পেশা এক হলেও এই চার এসি ল্যান্ড এসেছেন চার ধরনের পারিবারিক পটভূমি থেকে। তাঁদের মধ্যে বয়সে সবচেয়ে ছোট মতিঝিল রাজস্ব সার্কেলের মাহনাজ হোসেন। তিনিই একমাত্র ৩৫তম বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডার থেকে এসেছেন। বাকি তিনজন ৩৪তম বিসিএসের। মাহনাজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিন প্রকৌশল ও বায়োটেকনোলজি বিভাগ থেকে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইন্টারন্যাশনাল হেলথ অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিনে স্নাতকোত্তর করেছেন। থেকে যেতে পারতেন সেখানেই, কিন্তু মা ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ায় ফিরে এসেছেন দেশে।

মোহাম্মদপুর রাজস্ব সার্কেলের ইয়াসমিন মনিরার বিয়ে হয়েছিল নবম শ্রেণিতে থাকতেই। এরপর সংসার সামলে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত লেখাপড়া চালিয়ে যান তিনি। মনিরা বলেন, ‘সবাই আমার স্বামীকে জিজ্ঞেস করত, বউকে এত লেখাপড়া করিয়ে কী করবে? কিন্তু আমার পরিবারের মানুষেরা সব সময় পাশে ছিলেন।’

লালবাগ সার্কেলের ফারজানা রহমান একজন কৃষিবিদ। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ থেকে পড়াশোনা সম্পন্ন করে যোগ দিয়েছিলেন একটি ব্যাংকে। একই সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবসায় প্রশাসন বিষয়ে স্নাতকোত্তরও পড়ছিলেন। এত কিছু সামলে বিসিএসের জন্য প্রস্তুতি নেন, আর সফলও হন।

ঢাকার কোতোয়ালি সার্কেলের শাকিলা বিনতে মতিন পিরোজপুরে স্কুল ও কলেজ শেষ করে ঢাকায় এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজকল্যাণ বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছেন। গ্রামে বেড়ে ওঠা শাকিলারা চার বোন। তাঁর শিক্ষক বাবা চেয়েছিলেন, মেয়েরা সমাজে শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করুক। সেই স্বপ্নই বাস্তবায়ন করছেন শাকিলা।

এই চার নারী সহকারী কমিশনার (ভূমি) ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোতে কাজ করছেন। এখানে প্রভাবশালীদের চাপ থাকে, ভূমি দখল হয়ে যায় হরহামেশাই। জালিয়াতি কিংবা জমি নিয়ে বিরোধের ঘটনাও কম নয়। কিন্তু যখন কাজে নামেন, তখন শুধুই কর্মকর্তা, নারী নন-ঠিক এভাবেই নিজের অবস্থান পরিষ্কার করেন লালবাগ রাজস্ব সার্কেলের ফারজানা রহমান।

বলতে যত সহজ শোনায়, কাজটা আদতে তত সহজ নয়। চারজন নারীর তিনজনের কর্মক্ষেত্র পুরান ঢাকায়। এই এলাকায় বেশির ভাগ নারীর ভূমিকা গৃহকর্মেই সীমাবদ্ধ। ইয়াসমিন কাজ করেন মোহাম্মদপুরে, সেখানেও নারীদের অবস্থান খুব ভালো নয়। এ রকম সামাজিক বাস্তবতায় যখন ভূমি অফিসের প্রধান হিসেবে নারীদের পাওয়া যায়, তখন অনেক ক্ষেত্রেই পুরুষ সেবাপ্রার্থীরা বিষয়টি ইতিবাচকভাবে নিতে পারেন না। শাকিলা বলেন, ‘মাঝেমধ্যে কাজ করা জটিল হয়ে ওঠে। আবার ব্যতিক্রমও হয়। অনেক সময় নারী কর্মকর্তাদের কাছে নারী সেবাপ্রার্থীরা তাঁদের সমস্যার কথা সহজে এবং আস্থার সঙ্গে জানাতে পারেন।’

নারীদের প্রতি আছে দায়িত্ব নারী বলে নারীদের বিষয়ে দায়িত্ব অনুভব করেন এই চার কর্মকর্তা। বিশেষ করে নারীরা যখন জমির অধিকারের সন্ধানে আসেন। শাকিলা বলেন, ‘এটা খুবই দুঃখজনক যে আমাদের দেশে নারীদের পারিবারিক ভূমিতে প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করার প্রবণতা থাকে। এমনকি নারীরা এটাও সঠিকভাবে জানেন না যে তাঁদের জমির অবস্থান কোথায়।’

অধিকাংশ নারী ভূমি অফিস পর্যন্ত আসেনই না। যাঁরা আসেন, তাঁরাও অজ্ঞ করণীয় সম্পর্কে। শুধু সম্পদের হদিস জানলে উত্তরাধিকার উদ্ধার করা সম্ভব। কিন্তু এই কাজ করতে যে আইনের আশ্রয় নিতে হয়, সে ক্ষেত্রেও অনাগ্রহও দেখা যায় নারীদের মধ্যে। ‘এ রকম পরিস্থিতিতে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করি তাদের সহযোগিতা করার জন্য।’ বললেন শাকিলা।

মাহনাজ হোসেন বলেন, ‘দখল পুনরুদ্ধার, রেকর্ড সংশোধন ইত্যাদি বিষয়ে সঠিক আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে না গিয়ে অনেক নারীই ঝামেলা এড়াতে ভুল পদক্ষেপ নিয়ে থাকেন। এসব ক্ষেত্রে নারীর সাহস করতে হবে। যিনি ভুক্তভোগী তিনি যদি নিজে সাহস নিয়ে অন্য কারও ওপর নির্ভর না করে এগিয়ে আসেন, তবে আমাদের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করা সম্ভব। দেরি হলেও তার আইনগত অধিকার তিনি বুঝে পাবেন।’

চেষ্টা কাজে কোনো ঘাটতি না থাকার এই নারী কর্মকর্তারা সেবাগ্রহীতাদের জন্য উল্লেখ করার মতো কিছু কাজও করে যাচ্ছেন। যেমন ফারজানা সেবাগ্রহীতাদের একটি রেজিস্টার বানিয়েছেন। এর ফলে কেউ একবার লালবাগ রাজস্ব সার্কেলের এসি ল্যান্ড অফিসে সেবা নিতে এলে তাঁর প্রয়োজনটি লেখা থাকে। সমস্যা সমাধান হলে, এসি ল্যান্ড অফিস থেকেই তাঁকে ফোন করা হয়। এভাবে গত এক বছরে সেবাগ্রহীতাদের এসি ল্যান্ড অফিসে আসার হার ৩০ শতাংশ কমে গেছে।

গত ৩০ মার্চ প্রথম আলোয় প্রকাশিত ‘মৃত নারীকে জীবিত দেখিয়ে জমি দখলের চেষ্টা’ শিরোনামের খবরটির মূলে আছেন মতিঝিল সার্কেলের মাহনাজ হোসেন। তাঁর হাতেই ধরা পড়েছিল আসামি, নকল জাহেরুন নেসা।

এই চার এসি ল্যান্ডের প্রত্যেকেই স্বীকার করেছেন তাঁদের পরিবারের সদস্যদের সহায়তার কথা। এ ছাড়া তাঁরা সহকর্মী ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছ থেকেও কাজে সহায়তা পান। ফারজানা বললেন, ‘কাজটা এমনভাবে করার চেষ্টা করি যেন কখনো কোনো ঘাটতি না থাকে। আমরা যদি আমাদের যোগ্যতাকে প্রমাণ করতে পারি, তাহলে নারীদের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসার পথটা আরও সুগম হবে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *