ডা. এম এ হক, পিএইচ.ডি :
অটিজম শিশুর জন্মগত সমস্যা। অটিজমের বৈশিষ্ট্য নিয়েই শিশু মাতৃগর্ভ থেকে জন্মগ্রহণ করে। এই ধরনের শিশুদের আচরণগত পার্থক্য এক বছর থেকে তিন বছর বয়সের মধ্যেই চোখে পড়ে। শিশু অটিজমে আক্রান্ত শুনলে পিতা-মাতার আনন্দ যেন মুহূর্তের মধ্যেই বিলীন হয়ে যায়। তবে, আশার কথা হলো, অটিস্টিক শিশুদের আধুনিক চিকিৎসা এখন বাংলাদেশেই হচ্ছে।
অটিজম:
অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার এক ধরনের নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিসঅর্ডার; যেখানে অনেক ধরনের মানসিক সমস্যা বা প্রতিবন্ধকতা একসঙ্গে ঘটে থাকে। এই ধরনের নিউরোলজিক্যাল সমস্যার কারণে মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়; যার সঙ্গে মানসিক বিকাশগত জটিলতাও প্রকাশ পায়। এই সমস্যার কারণে জন্মের ১৮ মাস থেকে ৩ বছর বয়সের মধ্যেই শিশুর আচরণগত এবং মানসিক সীমাবদ্ধতা পরিলক্ষিত হয়। যার ফলে, কথা বলা বা ঠিকমতো শব্দ উচ্চারণ করা, নতুন জিনিস বুঝতে পারা বা শেখা কিংবা সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তোলা শিশুর জন্য বেশ বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়।
কারণ:
অটিজম জেনেটিক কারণে অর্থাৎ “সাইকোটিক মায়াজমের” প্রভাবে সৃষ্ট মানসিক বিকাশগত সমস্যা। “সাইকোটিক মায়াজম” ধারণাটি বিখ্যাত জার্মান চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও রসায়নবিদ ডা. স্যামুয়েল হ্যানিম্যান (১৭৫৫-১৮৮৩ খ্রি.) আবিষ্কৃত মতবাদ। মানব শরীরের সংঘটিত লক্ষণসমূহ একত্রিত করে ১৯০৮ সালে সাইকিয়াট্রিস্ট ইউজেন ব্লিউলার “অটিজম” শব্দটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন।
অস্ট্রিয়ান মেডিকেল থিয়োরিস্ট হ্যানস অ্যাসপারগার এবং আমেরিকান শিশু মনোবিজ্ঞানী লিও ক্যানার ১৯৪৩ সালে “অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার” শব্দটির ব্যবহার করেন।
লক্ষণ:
অটিজমের লক্ষণসমূহ শৈশব থেকেই প্রকাশ পেতে থাকে। স্বাভাবিক একটি শিশু এক বছর বয়সে অর্থবহ অঙ্গভঙ্গি করতে পারে, ১৬ মাস বয়স থেকে একটি শব্দ বলতে পারে এবং ২ বছর বয়সে ২ শব্দের বাক্য বলতে পারে কিন্তু অটিজম আক্রান্ত শিশুর মধ্যে এসব আচরণ দেখা যায় না। তার সমবয়সী শিশুদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চায় না। অনেক শিশু আবার ১ থেকে ২ বছর বয়স পর্যন্ত খেলাধুলা, কথাবার্তা সব ঠিক থাকে কিন্তু হঠাৎ করে কথা ও সামাজিক মেলামেশা বন্ধ করে দেয়। এটাকে বলা হয় রিগ্রেসিভ অটিজম। নাম ধরে ডাকলে সাধারণ শিশু সাড়া দেয়, কিন্তু অটিজমে আক্রান্ত শিশুর নাম ধরে ডাকলেও সাড়া দেয় না। এ ধরনের শিশু আপন মনে থাকতে পছন্দ করে। সবচেয়ে বড় কথা, এরা কারও চোখের দিকে তাকায় না। কারও দিকে তাকিয়ে হাসে না কিংবা আদর করলেও ততটা সাড়া দেয় না। সাধারণভাবে অটিস্টিক শিশুরা একই কথা বারবার বলে এবং একই কাজ বারবার করতে পছন্দ করে। অনেক অটিস্টিক শিশুর কিছু মানসিক সমস্যা যেমন অতি চঞ্চলতা, অতিরিক্ত ভীতি, মনোযোগের সমস্যা, ঘন ঘন মনের অবস্থা পরিবর্তন হওয়া, ঘুমের সমস্যা ইত্যাদি থাকে। অটিস্টিক শিশুরা বড় হয়েও স্বাভাবিকভাবে জীবন চালাতে পারে না।
চিকিৎসা:
অটিস্টিক শিশুদের চিকিৎসা সম্পর্কে বলা হয়, ‘এর ভালো কোনো চিকিৎসা নেয়’; কথাটি সম্পূর্ণ সঠিক নয়। বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতি অর্থাৎ হোমিওপ্যাথিতে অটিস্টিক শিশুদের ভালো মানের চিকিৎসা রয়েছে। নির্ভরযোগ্য বিকল্প চিকিৎসাসেবা থাকলে শিশুকে বিনা-চিকিৎসায় রাখা কতোটুক যুক্তিযুক্ত? যেখানে এই রোগ সম্পর্কে বলা হচ্ছে ‘নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিসঅর্ডার’ তাহলে শুধু থ্যারাপি এর কতোটুকু উন্নতি করতে পারে? থ্যারাপির প্রয়োজন চিকিৎসার সহযোগী হিসেবে মূল চিকিৎসার ভূমিকা সে পালন করতে সক্ষম নয়। এ বিষয়ে আরও অভিভাবকদের সচেতনতার প্রয়োজন। বিভিন্ন ধরনের জটিল মানসিক রুগী হোমিওপ্যাথিতে ভালো হয় একথা সকলেই জানেন। ‘অটিস্টিক শিশুদের’ সমস্যা যেহেতু ‘নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিসঅর্ডার’ এজন্য প্রয়োজন ‘নিউরো ডেভেলপমেন্টাল’ চিকিৎসায় অভিজ্ঞতা রয়েছে এমন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক। চিকিৎসা শুরু করার পর যদি রুগীর মানসিক উন্নতি হয়, পূর্বের তুলনায় মনোযোগী এবং নিজের কাজ নিজে করার আগ্রহ তৈরি হয় তাহলে বুঝতে হবে চিকিৎসা সঠিক হচ্ছে। তবে, একথা স্মরণ রাখতে হবে এই পরিবর্তন প্রথমদিকে ধীরে ধীরে হয়। অটিস্টিক শিশুদের চিকিৎসায় হোমিওপ্যাথির সফলতা এবং ঝামেলামুক্ত চিকিৎসা পদ্ধতিতে আকৃষ্ট হয়ে ক্রমেই এই চিকিৎসার প্রতি রুগীদের আস্থা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অটিস্টিক শিশুদের চিকিৎসায় আমি রোগীর ‘মায়াজমের’ দিকে খেয়াল রেখে প্রধাণত থুজা, মেডোরিনাম, সিফিলিনাম, টিউবারকুলিনাম, সোরিনাম, সালফার, ক্যালকেরিয়া কার্ব, ক্যালকেরিয়া ফস, ক্যালকেরিয়া ফ্লোর, কস্টিকাম, বেলেডোনা, ব্রায়োনিয়া, মার্কসল, ন্যাট্রাম-মিউর, ন্যাট্রাম-সালফ ইত্যাদি ওষুধ ব্যবহার করি। তবে স্মরণ রাখতে হবে, অটিস্টিক শিশুদের চিকিৎসায় অভিজ্ঞতা রয়েছে এমন চিকিৎসকের মাধ্যমে চিকিৎসা করাই উত্তম। আমাদের দেশে অটিস্টিক শিশুদের চিকিৎসায় অভিজ্ঞতাসম্পন্ন চিকিৎসক রয়েছেন। ফলে, অটিস্টিক শিশুদের আধুনিক চিকিৎসা এখন বাংলাদেশেই হচ্ছে। সর্বোপরি, পরিবার, আত্মীয়-পরিজন, সমাজ, শিক্ষক-শিক্ষিকাসহ সকলের সাহায্য সহযোগিতায় একটি অটিস্টিক শিশু স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে।
লেখক: ডা. এম এ হক, পিএইচ.ডি (স্বাস্থ্য), এম. ফিল (স্বাস্থ্য), ডিএইচএমএস। জটিল ও দুরারোগ্য রুগীর অভিজ্ঞ চিকিৎসক ও গবেষক।
চেম্বার: ১: হক হোমিও ক্লিনিক, বাসা নং-৫৩, রোড নং-২, মোহাম্মাদী হাউজিং লিঃ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা।
চেম্বার: ২: ড. হক হোমিও ট্রিটমেন্ট অ্যান্ড রিসার্র্স সেন্টার, বিটিআই সেন্ট্রা গ্রান্ড, গ্রাউন্ড ফ্লোর (জি-৪), ১৪৪ গ্রীন রোড, পান্থপথ, ঢাকা। মোবাইল: ০১৭১২-৪৫০ ৩১০;