দুর্বৃত্তদের নিশানা অরক্ষিত রেলপথ, দেড় মাসে ছয়টি নাশকতা

দেশে রেল বা ট্রেনে নাশকতা থামছে না। দুর্বৃত্তদের নিশানায় পরিণত হয়েছে অরক্ষিত রেলপথ ও নিরীহ যাত্রীরা। গাজীপুর, রাজধানীতে রেলে নাশকতার পর গত মঙ্গলবার রাতে দিনাজপুরের বিরামপুরে রাতের আঁধারে রেললাইনের স্লিপার উপড়ে ফেলেছে দুর্বৃত্তরা। তবে অল্পের জন্য বড় ধরনের দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পেয়েছে রেলের শতাধিক যাত্রী।

এ নিয়ে ঢাকায় সমাবেশ ভণ্ডুল হওয়ার পর বিএনপি ও সমমনারা যে হরতাল-অবরোধ পালন করে আসছে, তার মধ্যে রেলে ছয়টি বড় ধরনের নাশকতা দেখল বাংলাদেশ। এসব ঘটনায় প্রাণ গেছে নারী ও শিশুসহ পাঁচজনের, রেলের কর্মীসহ আহত হয়েছে অনেকে। পুরোপুরি পুড়ে গেছে রেলের সাতটি কোচ, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আরও আটটি কোচ এবং একটি ইঞ্জিন। এছাড়া লাইনে আগুন দেয়া, ফিসপ্লেট তুলে ফেলা, ককটেল বিস্ফোরণের বেশকিছু ঘটনার কথা জানিয়েছে রেলওয়ে। নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের ধারণা, অনেকটা অরক্ষিত, নির্জন ও নিরাপত্তাহীনতার কারণেই দুষ্কৃতকারীরা রেলপথকে নাশকতার টার্গেটে বা নিশানায় পরিণত করতে পারে।

এদিকে ‘মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস’ রেলের (ট্রেন) তিনটি বগিতে আগুনে নারী ও শিশুসহ চারজন যাত্রী নিহত হওয়ার ঘটনার কিছু প্রশ্নের উত্তর স্পষ্ট হয়নি। ফায়ার সার্ভিসসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধারণা, রেলটি শাহজালাল বিমানবন্দর রেলষ্টেশনে আসার পর আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। কিন্তু সেই জ্বলন্ত রেলটি ১২ কিলোমিটার চলার পর টের পেয়ে তেজগাঁও ষ্টেশনে থামান চালক। এতো দেরিতে কেন চালক জানতে পারলেন, এ ক্ষেত্রে দায়িত্বরত কর্মচারীদের ভূমিকা কী ছিল। এছাড়া রেলের জানালা খোলা ছিল না কি বন্ধ ছিল, চলন্ত গাড়িতে কীভাবে আগুন লাগলো, বগিতে থাকা অন্য যাত্রীরা কীভাবে বের হলেন, এক বগি থেকে আরেক বগিতে যাওয়ার দরজাটি খোলা না বন্ধ ছিল-এমন অনেক প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেড়াচ্ছেন লোকজন।

অন্যদিকে নেত্রকোনা থেকে আসা রাজধানীর তেজগাঁওয়ে ‘মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস’ নামক রেলে (ট্রেন) অগ্নিসংযোগ ও দগ্ধ হয়ে চারজনের মৃত্যুর ঘটনায় কমলাপুর রেলওয়ে থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। গত মঙ্গলবার রাতে ক্ষতিগ্রস্ত ট্রেনটির পরিচালক (গার্ড) খালেদ মোশাররফ বাদী হয়ে এই মামলা করেন। রেলওয়ে পুলিশের ঢাকা জেলার এসপি আনোয়ার হোসেন বলেন, বিশেষ ক্ষমতা আইন ও চারজনকে হত্যার পৃথক অভিযোগ আনা হয়েছে মামলায়। বিশেষ ক্ষমতা আইন ও দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায় মামলাটি দায়ের করা হয়। তবে মামলায় কারও নাম উল্লেখ করা হয়নি। মামলার আসামি অজ্ঞাত। অপরদিকে তেজগাঁওয়ে ট্রেনে আগুনের ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটনে কাজ শুরু করেছে পাঁচ সদস্যের কমিটি।

চারজনের মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর: ওদিকে ওই দুর্বৃত্তদের দেয়া আগুনে দ্বগ্ধ খোকন মিয়া ও রশীদ ঢালীর মরদেহ শনাক্তের পর ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। গতকাল বুধবার বেলা তিনটা ও সাড়ে তিনটার দিকে খোকন মিয়ার (৩৪) মরদেহ তার স্ত্রী সাজনের কাছে এবং রশিদ ঢালীর(৬০) মরদেহ তার ছেলে মামুনের কাছে হস্তান্তর করে পুলিশ।

রাজধানীর তেজগাঁওয়ে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনে দুর্বৃত্তদের দেয়া আগুনে দগ্ধ হয়ে নিহত চারজনের মধ্যে একজন নেত্রকোনা পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাবেক সভাপতি আব্দুর রশিদ ঢালী। রশিদ ঢালী বিএনপির নেত্রকোনা পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ড শাখার সাবেক সভাপতি। এর আগে তিনি জেলা যুবদলের নেতা ছিলেন। তিনি বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন বলে জানিয়েছেন নেত্রকোনা জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক এসএম মনিরুজ্জামান দুদু। এর আগে গত মঙ্গলবার রাতেই নিহত মা নাদিয়া আক্তার পপি ও তার তিন বছরের শিশু সন্তান ইয়াসমিনের মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন পার হওয়ার পর আগুন দেখা যায় ট্রেনে ডিবির দাবি: মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনটি টঙ্গী স্টেশনে থামেনি। থেমেছিল ঢাকা বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনে। এর আগে ট্রেনটির স্টপেজ ছিল গফরগাঁও ও ময়মনসিংহ জংশনে। বিমানবন্দর স্টেশন থেকে তেজগাঁও স্টেশনে পৌঁছাতে সময়ের হিসাবে দূরত্ব ১৮ মিনিটের। ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন পর্যন্ত ট্রেনটিতে আগুন দেখা যায়নি। কিন্তু তেজগাঁও স্টেশনে পৌঁছার আগে টের পাওয়া যায় ট্রেনে আগুন লেগেছে। ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন পার হওয়ার পর সৈনিক ক্লাবের আগে ট্রেনে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে।

ঢাকা বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন থেকে সৈনিক ক্লাব পর্যন্ত দুই শতাধিক সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণের পর এমনটাই  দাবি করেছে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। মর্মান্তিক ওই ঘটনার পর ছায়াতদন্ত শুরু করেছে র‌্যাব, থানা পুলিশ, পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি), অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ও কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি)।

রেলওয়ে পুলিশের ঢাকা জেলার এসপি আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘রেলওয়ে পুলিশ ঘটনাটি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছে। যদিও আমরা এখন পর্যন্ত জড়িত কাউকে শনাক্ত বা গ্রেপ্তার করতে পারিনি।’

তেজগাঁও গোয়েন্দা বিভাগের উপ-কমিশনার গোলাম সবুর বলেন, ‘আমরা কাজ করছি। উত্তরা থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। উত্তরা, গুলশান ও তেজগাঁও গোয়েন্দা বিভাগ তদন্ত করছে। আমরা এখন পর্যন্ত সন্দেহভাজন কাউকে শনাক্ত করতে পারিনি, চেষ্টা চলছে।’

তবে, গুলশান গোয়েন্দা বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা প্রথমত ঢাকা বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন থেকে শুরু করে সম্ভাব্য সব সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে বিশ্লেষণ শুরু করেছি। এখন পর্যন্ত আমাদের অবজারভেশন, মিডিয়াতে যেভাবে আসছে তা সঠিক মনে হয়নি। আমরা এর প্রমাণও পেয়েছি। অর্থাৎ আগুন কোন এলাকায় লাগানো হয়েছে তার সুস্পষ্ট প্রমাণ মিলেছে সিসিটিভি ফুটেজে।

দেড় মাসে রেলে যত নাশকতা: নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় ‘মহাসমাবেশ’ ডেকেছিল বিএনপি। তবে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের জেরে সেই আয়োজন ভল্ডুল হয়ে যায়। তারপর থেকেই বিএনপি ও সমমনারা হরতাল ও অবরোধের মতো কর্মসূচি দিয়ে আসছে। এর মধ্যে গত ১৫ নভেম্বর দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন, যাতে ৭ জানুয়ারি ভোটের তারিখ রাখা হয়েছে। এ ভোট বর্জন করে বিএনপি রাজপথের আন্দোলনেই থাকতে চাইছে। তবে হরতাল-অবরোধ কর্মসূচির শুরু থেকেই বাস, ট্রাক, রেলসহ বিভিন্ন পরিবহন ও স্থাপনায় নাশকতার খবর আসছে।

বাংলাদেশ রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের তথ্য বলছে, গত ১৬ নভেম্বর রাতে টাঙ্গাইল স্টেশনে টাঙ্গাইল কমিউটার বেল বা ট্রেনের কোচে আগুন দেয়া হয়। ওই ট্রেনটি সকালে ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়ার কথা ছিল। ওই ঘটনায় ট্রেনের দুটি কোচ পুড়ে যায়। দুই দিন বাদে ১৯ নভেম্বর রাতে জামালপুরের সরিষাবাড়ী স্টেশনে ট্রেনে থেমে থাকা যমুনা এক্সপ্রেস ট্রেনে আগুন দেয়া হয়। এ সময় দুটি কোচ পুড়ে যায়, ক্ষতিগ্রস্ত হয় আরও একটি কোচ। ২২ নভেম্বর রাতে সিলেট রেলস্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা ঢাকাগামী উপবন এক্সপ্রেস ট্রেনের একটি কোচে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। ওই ঘটনা ঘটে রাত ৯টার দিকে, রাত ১১টায় ট্রেনটি ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়ার কথা, ফলে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।

রেল বা ট্রেনে নাশকতা নতুন মাত্রা পায় গত ১৩ ডিসেম্বর। সেদিন রেলওয়ের ভাওয়ালগাজীপুর এবং রাজেন্দ্রপুর সেকশনে ২০ ফুট রেললাইন কেটে ফেলা হয়। ভোরে ঢাকাগামী মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেন সেখানে দুর্ঘটনায় পড়ে। ট্রেনের ইঞ্জিন এবং ছয়টি কোচ লাইন থেকে ছিটকে পড়লে একজন নিহত হয়। আহত হয় অনেকে। ওই ঘটনায় পুরো একদিন ঢাকা ময়মনসিংহ রুটে ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল। আর গত মঙ্গলবার ভোরে ঢাকার তেজগাঁওয়ে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে আগুনের ঘটনায় পুড়ে যায় তিনটি বগি। যাত্রী ভর্তি এ ট্রেনে আগুনে পুড়ে মারা গেছেন এক মা ও তার শিশু সন্তানসহ মোট চারজন। একই দিন রাতে দিনাজপুরের বিরামপুর রেল স্টেশনে নাশকতার চেষ্টা চালিয়েও সফল হতে না পারায় প্রাণে রক্ষা পান শতাধিক যাত্রী।

বাংলাদেশ রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চল জানিয়েছে, ৩১ অক্টোবর গাজীপুরের জয়দেবপুর থেকে হাইটেক সিটি অংশে মৌচাকে রেলওয়ের ২৬ নম্বর সেতুর অ্যাপ্রোচে টায়ার জ্বালিয়ে আগুন দেয়া হয়। সেদিন ১৪ নম্বর সেতুতে রেলের ফিসপ্লেট এবং বোল্ট খুলে ফেলা হয়। এদিন মৌচাক ইয়ার্ডে ককটেলের বিস্ফোরণ এবং ট্রেনে পাথর নিক্ষেপ করে অবরোধ সমর্থকরা।

রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চল জানিয়েছে, ২৭ অক্টোবর ঈশ্বরদী ওয়াশপিট লাইনে যাওয়ার সময় একটি ট্রেনের কোচে আগুন ধরিয়ে দিলে কয়েকটি সিট পুড়ে যায়। ১৫ ডিসেম্বর উত্তরা এক্সপ্রেস জয়পুরহাট স্টেশনে ঢোকার সময় একটি কোচে আগুন দেয় দুষ্কৃতিকারীরা। এতে ওই ট্রেনের সিট পুড়ে যায়। অজ্ঞাত কারণে দুর্বৃত্তদের টার্গেটে পরিণত হয়েছে রেল কিংবা রেলের যাত্রী।

ঢাকায় যাত্রীবাহী ট্রেনে অগ্নিসংযোগে চার ব্যক্তির প্রাণহানির ঘটনায় জড়িতদের নিরাপত্তা বাহিনী খুঁজে বের করবে বলে গতকাল জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। তিনি বলেন, যারা অমানুষ, যারা জানোয়ার, তারাই এসব ঘটনা ঘটাতে পারেন। যারা এ কাণ্ড ঘটিয়েছে, নিরাপত্তা বাহিনী তাদের খুঁজে বের করবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *