সিজিএসের গোলটেবিল একতরফা নির্বাচন ঝুঁকি বাড়াবে অর্থনীতিতে

আবার দেশে একতরফা নির্বাচন হতে যাচ্ছে। এতে সরকারি দলের হারার সুযোগ নেই। ঠিক নির্বাচন বলা যাবে না, এটা নাটক। দেশে এবং বহির্বিশ্বে কোথাও এটি গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। রাজনীতি হারিয়ে যাবে। দেশে অর্থনৈতিক ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে তুলবে। অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে। তাই উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়া সম্ভব নাও হতে পারে। 

গতকাল বুধবার রাজধানীর একটি হোটেলে ‘ক্রান্তিকালে বাংলাদেশ : নির্বাচন, অর্থনীতি এবং বহিঃসম্পর্ক’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা এসব কথা বলেন। এই আয়োজন করে সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস)। সঞ্চালনা করেন সিজিএসের নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমান।

এতে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, বৈধতা থাকুক বা না থাকুক, আমরা একটি একপাক্ষিক নির্বাচনের দিকে যাচ্ছি। এখানে সরকারি দল কারা হবে ও বিরোধী দল কারা হবে, তা আগেই ঠিক করে রাখা হয়েছে এবং তথাকথিত বিরোধী দল ইতোমধ্যে সিট ভিক্ষার রাজনীতি শুরু করেছে। দেশের তরুণ সমাজ টানা তিনটি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারছে না, এটি অত্যন্ত দুঃখজনক। এমন পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি সামনে উপস্থিত হয়েছে। এ কারণে সার্বিক অর্থনীতিতেও হুমকির আশঙ্কা রয়েছে।

সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতির ভুলের কারণে অর্থনীতি অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। অর্থনীতি খারাপ হওয়ার মূল কারণ রাজনৈতিক অস্থিরতা। দেশে মূলত উন্নতি হয়েছে কয়েকটি সূচকের। কিছু মানুষের আয় বেড়েছে অসমহারে। আবার কেউ কেউ কিছুই পাচ্ছে না। এই ভারসাম্যহীন উন্নয়ন কোনো কাজে আসছে না। সরকার দেশের অর্থনীতির অভ্যন্তরীণ সমস্যা ব্যাংকিং, দুর্নীতি, অপচয়, প্রকল্পে অতিরিক্ত ব্যয় পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে।  রপ্তানি নিয়ে সরকারের একেক সংস্থা একেক তথ্য দিচ্ছে। বিদেশ থেকে আনা ঋণের টাকার অপচয় হচ্ছে। ১০ টাকার জিনিসের ক্ষেত্রে ৫০ টাকা ব্যয় করলে কীভাবে ফেরত দেব? মানুষ কী চায়? টানেল চায়, নাকি কালভার্ট চায়? বিশাল হাসপাতাল করলেন, ডাক্তার নাই।

গোলটেবিল আলোচনায় সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ভাগাভাগির পর সরকারি দলের ২৪০ আসন নিশ্চিত। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের নতুন সংজ্ঞা তৈরি করা হচ্ছে। কেউ কেউ বলতে চাচ্ছেন, জনগণ অংশগ্রহণ করলেই অংশগ্রহণমূলক। তাহলে স্বৈরশাসকদের সময়ের নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তোলেন কেন? সবকিছু ঠিক থাকলেও আগামী নির্বাচনে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ ভোটার উপস্থিত হবে কিনা, তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। এই নির্বাচনের পর দেশের রাজনীতি হারিয়ে যাবে। প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ রাজনীতি আর দেশে থাকবে না। উদার গণতন্ত্রের কথা ভুলে যেতে হবে, বিশেষায়িত গণতন্ত্রে প্রবেশ করবে দেশ। একটা বিরোধী দল খোঁজার জন্য এই নির্বাচন।

সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন বলেন, এখানে (বাংলাদেশে) পশ্চিমারাও হস্তক্ষেপ করে, আবার অ-পশ্চিমারাও হস্তক্ষেপ করে। এখন বলা হচ্ছে, পশ্চিমারা হস্তক্ষেপ করে। ২০১৪ সালে ভারত কি এখানে হস্তক্ষেপ করেনি? তিনি আরও বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে যে ভাষ্য আসছে, তাতে পশ্চিমের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক করার কোনো লক্ষণ বা প্রমাণ দেখা যাচ্ছে না। তাদের বাদ দিয়ে কি আমরা চলতে পারব? যদি কোনো নিষেধাজ্ঞা আসে, তাহলে তো ক্রয়ক্ষমতা থাকবে না। কোনোভাবেই দুর্ভিক্ষ ঠেকানো যাবে না।

নিউএজের সম্পাদক নূরুল কবির বলেন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক পদক্ষেপ সুষ্ঠু নির্বাচন। অসাধু ব্যবসায়ী, অসাধু রাজনীতিবিদ ও আমলারা মিলে একটি চক্র তৈরি করেছেন। সরকার মানুষের আকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে একদলীয় নির্বাচন করতে যাচ্ছে। এতে ভারত, রাশিয়া ও চীন সমর্থন দিচ্ছে। তাদের কাছ থেকে আমরা অর্জিত আয় দিয়ে পণ্য ক্রয় করি। ইউরোপ, আমেরিকায় পণ্য রপ্তানি করে আয় করি। স্বার্থ কোন দিকে বেশি, সেই অর্থনৈতিক অঙ্কও হিসাব করতে হবে।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, সরকার উন্নয়নের যে বয়ান দিচ্ছে, তার সঙ্গে মানুষের জীবনযাত্রার মান, ভোগান্তির চিত্র মিলছে না। রাজস্ব, আমদানি, রপ্তানি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের সূচক নিম্নমুখী। মূল্যস্ফীতিকে চাপিয়ে রাখা হচ্ছে, ১০ শতাংশ পার করতে দেয় না। সরকার জিডিপির যে সংখ্যা দিচ্ছে, তাতে মনে হয়, শনৈঃ শনৈঃ উন্নতি করছে। বাস্তবে এই জিডিপির দাবি ধোপে টেকে না। উন্নয়নের বয়ান দিয়ে চলা যায়; কিন্তু অবস্থার পরিবর্তন করা যায় না। তিনি বলেন, নির্বাচনের পর সরকারের সামনে আরও চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে। যে নকশাতেই নির্বাচন হোক, অর্থনৈতিক সমস্যাগুলোকে গুরুত্ব না দিলে তা আত্মঘাতী হয়ে যেতে পারে।

সিজিএস চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, এই নির্বাচনকে ঠিক নির্বাচন বলা যাবে না, এটা নাটক। এই নাটকে খলনায়ক আছে, পার্শ্বনায়ক আছে, এমনকি ডামি নায়কও আছে। শুধু নেই মূল নায়ক। দেশে মানবাধিকার, নাগরিক অধিকার, ভোটাধিকার ক্রমাগত লুণ্ঠিত হচ্ছে।

সিজিএস চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, এই নির্বাচনকে ঠিক নির্বাচন বলা যাবে না, এটা নাটক। এই নাটকে খলনায়ক আছে, পার্শ্বনায়ক আছে, এমনকি ডামি নায়কও আছে। শুধু নেই মূল নায়ক। দেশে মানবাধিকার, নাগরিক অধিকার, ভোটাধিকার ক্রমাগত লুণ্ঠিত হচ্ছে।

সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে কাজে লাগিয়ে বর্তমান সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করেছিল, যা অসাংবিধানিক। আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে। অসাংবিধানিক পদ্ধতিতে প্রণীত নিয়মে নির্বাচন হতে যাচ্ছে। একচেটিয়া অংশগ্রহণের এই নির্বাচন দেশের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করবে।

ড. মুহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেন, দেশের অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা খুবই উদ্বেগজনক। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের হিসাবের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব মিলছে না। তাঁর মতে, দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী দেখিয়ে কিছু লোক অর্থ লোপাট করেছে এবং তাদের নিজেদের পকেট সমৃদ্ধ করেছে; কিন্তু দেশের সমৃদ্ধি ঘটেনি।

ড. মুহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেন, দেশের অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা খুবই উদ্বেগজনক। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের হিসাবের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব মিলছে না। তাঁর মতে, দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী দেখিয়ে কিছু লোক অর্থ লোপাট করেছে এবং তাদের নিজেদের পকেট সমৃদ্ধ করেছে; কিন্তু দেশের সমৃদ্ধি ঘটেনি।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে বৈধতার সংকট দেখা দিয়েছে। এ সরকারের সাংবিধানিক বৈধতা থাকলেও রাজনৈতিক বৈধতা নেই। সবকিছু একটি দলকেন্দ্রিক হয়ে যাওয়ার কারণে ন্যায় ও ন্যায্যতা নেই। বিচারব্যবস্থা সবার জন্য সমভাবে কাজ করছে না। অর্থনীতিতেও তৈরি হয়েছে বিশাল বৈষম্য। কিন্তু রাজনীতি ও অর্থনীতি একটি অপরটির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তার সঙ্গে বৈশ্বিক সম্পর্কও খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক। এখন যেভাবে চলছে, সেভাবে চলতে থাকলে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়া সম্ভব নাও হতে পারে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যান ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, এখানে ভুল ও অসত্য তথ্য দিয়ে উন্নয়নের পক্ষে বয়ান তৈরি করা হয়। আগে উন্নয়ন পরে গণতন্ত্র।

এতে আরও বক্তব্য দেন– জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মুহাম্মদ আবদুল মজিদ, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক ফারুখ ফয়সল, সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না, নিরাপত্তা বিশ্লেষক এয়ার কমান্ডার (অব.) ইশফাক ইলাহী চৌধুরী প্রমুখ। ঢাকায় অবস্থানরত কয়েকটি দূতাবাসের কর্মকর্তারা এতে অংশগ্রহণ করেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *